জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি
অন্য অলিম্পিয়াডগুলোর সঙ্গে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের একটু পার্থক্য আছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াড সাধারণত হয় প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা, অংশ নিয়ে পারে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আইজেএসও অনুষ্ঠিত হয় অনুর্ধ্ব ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড বা যে কোন অলিম্পিয়াডে ভালো করার জন্য তোমাকে প্রথমেই বুঝতে হবে অনুশীলনী আর সমস্যার মধ্যে পার্থক্য। তোমার স্কুলের একটা পরীক্ষার চাইতে অলিম্পিয়াডের মূল পার্থক্য হলো, এখানে কখনও একটা অনুশীলনী আসবে না, আসবে সমস্যা। এখন প্রশ্ন হলো, অনুশীলনী মানে কী বুঝাচ্ছে?
আসলে অনুশীলনী আর সমস্যার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। অনুশীলনীতে থাকে এমন প্রশ্ন যার উত্তর বের করার জন্য নির্ধারিত একটি পদ্ধতি আছে। একটা অনুশীলনীর উদহারণ দেখা যাক,
সালফিউরিক এসিড (H2SO4)-এর আণবিক ভর কত?
এই প্রশ্নটি দেখো। কীভাবে সমাধান করতে হবে তুমি নিশ্চয় ক্লাসে শিখেছো। প্রথমে প্রত্যেকটা পরমাণুর পারমাণবিক ভরকে উপস্থিত পরমাণুর সংখ্যা দিয়ে গুণ করতে হবে। তারপর গুণফলগুলো যোগ করে পেয়ে যাবে আণবিক ভর। এই সমাধানের পদ্ধতিটা দেখো, বইয়ে ঠিক এই ধাপগুলোর কথাই বলা আছে। ধাপগুলো অনুসরণ করলে খুব সহজেই সমাধানে পৌছা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্নটা যদি অনুশীলনী না হয়ে ‘সমস্যা’ হয়, তবে কিন্তু তা সমাধানের কোন নির্ধারিত পদ্ধতি নাই। সমাধানের জন্য যে সূত্র বা তত্ত্ব দরকার তা হয়ত তোমার জানা আছে, কিন্তু সমাধান পদ্ধতি নির্ধারিত নাই। বুদ্ধি দিয়ে তোমাকে বুঝতে হবে কীভাবে তা সমাধান করা যায়। সত্যিকার একটা সমস্যা কেমন হতে পারে একটা উদহারণ দেওয়া যাক। সমস্যাটা রসায়নের,
একটা যৌগের স্থুল সংকেত CH2O, CH অথবা N2O। যৌগটির একটা অণুতে মোট ইলেক্ট্রন ৯৬টি। যৌগটির আণবিক সংকেত কী?
তমি নিশ্চয় স্থুল সংকেত কী জান, এ সংক্রান্ত কিছু অনুশীলনীও নিশ্চয় তুমি করেছ। তবে এই সমস্যার সমাধান করতে কিন্তু শুধু তা জানলেই চলছে না, সঙ্গে জানতে হবে ইলেক্ট্রন প্রোটনের হিসাব। এমনকি কোন একটি সংখ্যার উতপাদক-গুণণীয়কের ধারনার বুদ্ধিও ব্যবহার করতে হবে। তার চাইতে বড় কথা, এমন একটি প্রশ্নের উত্তর তুমি হয়ত কখনও কর নাই। এই প্রশ্নের উত্তর করার জন্য কোন ধাপের পর কোন ধাপ করত হবে তা হয়ত তোমার জানা নেই।
অনুশীলনীর প্রশ্নের উত্তর অনেক অনেক চর্চার মাধ্যমে আমরা প্রায় মুখস্থের মত করে ফেলতে পারি। কিন্তু অলিম্পিয়াডের সমস্যা সমাধান চর্চার মাধ্যমে মুখস্থ করে ফেলা সম্ভব নয়। প্রতিটা নতুন সমস্যাকে তোমার নতুন পদ্ধতিতে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যদি সব সমস্যাই একদম আলাদা হয়, নতুন হয়, তাহলে কি এক্ষেত্রে দক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই?
অবশ্যই সুযোগ আছে। সমস্যা সমাধানে দক্ষ হওয়ার উপায় হলো বেশি বেশি সমস্যার সমাধান করা। এতে করে নতুন নতুন সমাধান পদ্ধতি তুমি নিজে খুঁজে বের করতে পারবে। অভ্যাস হয়ে যাবে একটা সমস্যাকে নানান দিক থেকে আক্রমণ করার। এভাবেই তুমি একজন দক্ষ প্রবলেম সলভার হয়ে উঠবে।
এবার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলা যাক। কোন একটা সমস্যা তুমি মুহুর্তেই সমাধান করে ফেলাই কিন্তু মূল কৃতিত্ব না, বরং কোন একটা সমস্যা সমাধান করতে না পারলে দীর্ঘ সময় ধরে, মাঝে মাঝে দীর্ঘ দিন ধরে ওই সমস্যার পেছনে লেগে থাকতে হবে। তবেই তুমি হতে পারবে সমস্যা সমাধানে দক্ষ।
এবার আসা যাক সরাসরি অলিম্পিয়াডে। আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে প্রশ্ন হবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান থেকে। সমস্যা থাকবে মোট ১২ টি। সমস্যার সমাধান করার জন্য সময় পাওয়া যাবে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট।
প্রস্তুতি হিসেবে পড়তে হবে ক্লাসের বিজ্ঞান ও গণিত সংশ্লিষ্ট বইগুলো। তবে শর্ত হল পড়তে হবে বুঝে বুঝে। যেমন শুধু সূত্রের প্রমাণ আর সংজ্ঞা পড়ে বিডিজেএসওর সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে। এজন্য মূল ব্যাপারগুলো পড়ে বুঝতে হবে। কোন একটা তত্ত্ব কেন ও কীভাবে কাজ করে সেজন্য ভাবতে হবে, তবেই হবে বিডিজেএসওর প্রস্তুতি।
বিডিজেএসওতে সরাসরি কোন গণিতের সমস্যা সমাধান করতে হবে না। তবে গণিতের ধারণাগুলো প্রয়োজন পড়বে সমস্যা সমাধানের জন্য। বিশেষভাবে দরকার সমীকরণ ও লেখচিত্র সংক্রান্ত গণিতের ধারণা। গণিত বইয়ের এই অংশটা পড়তে হবে খুব ভালো করে। জ্যামিতির ক্ষেত্রে কোণ-ক্ষেত্রফল-আয়তন এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে ভালো করে। সেকেন্ডারি ক্যাটাগরির জন্য পড়তে হবে কিছুটা ত্রিকোণমিতিও। এককের ধারণা আর ঐকিক নিয়ম খুব ভালো করে বোঝা থাকা চাই।
পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বইয়ে থাকা অনুশীলনীর সমস্যাগুলো বুঝে বুঝে সমাধান করলে কাজে লাগবে। বিডিজেএসও-তে মূলত গাণিতিক সমস্যাই থাকবে বেশি। যেহেতু সরাসরি বইয়ের মতো সমস্যা থাকবে না তাই সূত্রগুলোর অনুধাবন করে পড়লেই কাজে দেবে বেশি। সম্ভব হলে বইয়ের সব গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে ফেলা উচিত।
রসায়নের ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ সমস্যা হবে গাণিতিক। তাই তত্ত্ব বোঝার পাশাপাশি গাণিতিক সব সমস্যার সমাধান করে ফেলা উচিত। জৈব যৌগ অংশ থেকে তেমন কোন সমস্যা থাকবে না। তবে পরমাণু-অণুর গঠন, বন্ধন সাম্যাবস্থার মত ধারণাগুলো খুব স্পষ্ট থাকা চাই। পদার্থের অবস্থা, দশা পরিবর্তন বা দ্রবণ-মিশ্রণের মত বিষয়গুলো অনুধাবন করে পড়তে হবে। অনুধাবন করে পড়লে এই অংশগুলোর সমস্যা সমাধান করা সহজ হবে।
জীববিজ্ঞানে একেবারে তথ্যমূলক সমস্যা থাকার সম্ভাবনা নাই। অনেকের ধারণা জীববিজ্ঞান মুখস্থ করার বিষয়, কিন্তু তথ্য মুখস্থ করে জীববিজ্ঞান অংশে ভালো করা কঠিন হবে। বরং পুরো বই বুঝে পড়ে ফেললে বেশি কাজে দিবে। কোন জৈব প্রক্রিয়া কীভাবে হচ্ছে তা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে ওই প্রক্রিয়া কেন হচ্ছে। জীববিজ্ঞান থেকে কিছু গাণিতিক সমস্যাও থাকতে পারে, সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কোনকিছুর বৈশিষ্ট, প্রকারভেদ বা সংজ্ঞা আসবে না জীববিজ্ঞানের সমস্যা অংশে।
উপরের এই কথাগুলো জুনিয়র, সেকেন্ডারি বা স্পেশাল—সব ক্যাটাগরির জন্য সত্য। স্পেশাল ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন আর সেকেন্ডারি ক্যাটাগরির প্রশ্ন একই হবে, শুধু মূল্যায়ন হবে আলাদা। তাই স্পেশাল ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদের ৯ম-১০ম শ্রেণির বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে জানতে হবে। এছাড়া উচ্চমাধ্যমিকে পড়া বিষয়গুলোও জানা থাকা উচিত। কারণ তাদের প্রতিযোগিতা হবে মূলত উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই।
সেকেন্ডারির শিক্ষার্থীদের প্রথম কাজ হবে নিজের ক্লাসের বইগুলো খুব ভালো ভাবে পড়ে ফেলা। স্কুলে সিলেবাস যতটুকুই শেষ হোক, বিডিজেএসও-তে ভালো করবে এমন শিক্ষার্থীর বইয়ের পুরো সিলেবাসই শেষ করে ফেলা উচিত। বই শেষ করার পর আরও পড়ার সুযোগ পেলে উচ্চমাধ্যমিকের বই পড়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে পড়া মানে নির্দিষ্ট টপিকের যত সমস্যা পাওয়া যায় সেগুলো সমাধান করা সহ পড়া। আর পড়ার জন্য এই লিংকে যে বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছে, ওই তালিকা ধরেও প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে।
জুনিয়র ক্যাটাগরির জন্য ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণির বিজ্ঞানগুলোই মূলত সিলেবাস। এ বইগুলোতে গাণিতিক সমস্যা খুব বেশি নাই। তবে গাণিতিক সমস্যা নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই, তোমার ক্লাসের গণিত বইয়ের ধারণা স্পষ্ট থাকলেই সহজেই পারবে সমাধান করতে। আঞ্চলিক পর্বে সমস্যাগুলো সমাধান করতে এই বইগুলোর সব ধারণ স্পষ্ট করে বোঝাই যথেষ্ট।
জাতীয় পর্বে এক শব্দে উত্তরের সমস্যার পাশাপাশি থাকবে বিশদ উত্তর করার জন্য প্রশ্নও। এসব প্রশ্নের সমাধান কিন্তু তোমাকে ধাপসহ লিখতে হবে। তাই জাতীয় পর্বের প্রস্তুতির জন্য বিশদ উত্তর লিখে সমাধান করার মত সমস্যার চর্চাও করত হবে।
জাতীয় পর্বের প্রস্তুতিতে জুনিয়রের শিক্ষার্থীরা ৯ম-১০ম শ্রেণির বই থেকে কিছু ধারণা নিতে পারো। এই লিংকে গিয়ে এনসিটিবির যে কোনো শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ডাউনলোড করে নিতে পারো অথবা বড় কারও থেকে একটা বই জোগাড় করে পড়তে পারো। এতে নতুন বিষয় যেমন জানবে, তেমনি তোমার মধ্যে তৈরি হবে আত্মবিশ্বাস।
মনে রাখতে হবে, বিডিজেএসও হয় বিজ্ঞানের সকল বিষয়ের উপর। তোমার হয়ত পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের শুধু একটি বিষয় অনেক বেশি ভালো লাগে। শুধু সেই বিষয়টি পড়লেই কিন্তু হবে না। পড়তে হবে সবগুলো বিষয়ই। যেহেতু প্রতিটা বিষয় থেকে এক-তৃতীয়াংশ প্রশ্ন হবে, কোন একটি বিষয় বাদ দিলে তুমি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে।
জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড : সমস্যা ও সমাধান সংকেত বই থেকে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের প্রশ্নের ধরণ যেমন বুঝতে পারবে, তেমনি পেয়ে যাবে সমাধানের সংকেত।
অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তুমি বিভিন্ন সময় আটকে যেতে পারো। সেজন্য দরকার হতে পারে বড়দের সহায়তা। প্রয়োজনে সে সহায়তা নাও। বড়দের পরামর্শও নাও। তবে সবসময় বড়দের সহায়তা না নিয়ে নিজেই চেষ্টা করো সমাধান খুঁজতে। এজন্য ইন্টারনেটে সার্চ দিতে পারো। তোমার সমস্যা নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে পারো। বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করলে বিষয়গুলোর খুঁটিনাটি তুমি আবিস্কার করতে পারবে। তাতে সুবিধা হবে অনেক বেশি, সমস্যা সমাধানের সময় চিন্তা করতে পারবে গভীরভাবে।